দুর্গাপুজো ..চারিদিকে হৈহৈ রৈরৈ, কী বা আছে এমন ? চারটে তো মাত্র দিন? মা এই আসবে, আর এই চলে যাবে, তার জন্য কেন একবছর ধরে অপেক্ষা করে থাকা? সারাবছরের স্কুল, কলেজ, অফিস এই কর্মব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি পাবো বলে? নাকি সব বাঁধন ভুলে গিয়ে মন খুলে আনন্দ করবো বলে?
বেশ ছোট্টবেলার কথায় যাওয়া যাক, তখনো বন্ধুদের সাথে একা একা রাস্তায় বেরোনোর মতো বয়স হয়নি আমার, তখন বাবার হাত ধরেই লাফিয়ে লাফিয়ে সকাল বিকেল উত্তর-কলকাতা, দক্ষিণ-কলকাতা চষে বেড়ানো | বাবার ও এনার্জি ছিল বটে !! চারিদিকে এতো মানুষের ভিড়, আলোর রোশনাই, ফুচকা-আলুকাবলি-আইসক্রিম এর টান, বেলুন ফাটার শব্দ ..বাচ্চা-আমি র রক্ত তো তখন ফুটছে | সারাবিকেল, সারাসন্ধ্যে হেটে হেটে ঠাকুর দেখে, কলেজ-স্কোয়ারে রাত সাড়ে এগারোটাতে এসে দুবার পাক খাওয়া লম্বা লাইনটা দেখেও আমি যখন বায়না করলাম, বাবা এই ঠাকুরটাও দেখবো, বাবার মুখে কিন্তু না নেই!! মনে আছে, ভিড় কম হবে বলে প্রতিবারই নবমী র দিন সকালে বাবা র সাথে কুমোরটুলি র ঠাকুরটা দেখে আসতাম আর বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানোর সময়ে ভাবতাম, কবে বাবা র মতো ভালো বেলুন ফাটাতে পারবো | ছোটবেলাটা হারিয়ে গেছে, কিন্তু বেলুন ফাটানোর পাগলামো টা কিন্তু রয়েই গেল; গ্র্যাজুয়েশনের দ্বিতীয় বছর- বড় আমি ও সুমনদা, প্রান্তরদা, রাজর্ষি র সাথে বেরিয়ে বেলুন ফাটিয়েছিলাম – হ্যাঁ তখন আমার নিশানা বাবার মতই নিপুণ| পুজোর পর পর ই স্কুল এ পরীক্ষা থাকতো, তাই দশমী টা আসলেই মনটা খারাপ হয়ে যেত. মনে হতো, এতো কিসের তাড়া মা দুর্গার? সারাটা বছর না হোক, আর কটা দিন তো থেকে গেলেই পারে!!
একটু যখন বড়োর দিকে, তখন একবার শুরু হলো, পাড়ার সবাই মিলে সারারাত ঠাকুর দেখার রেওয়াজ!! সে আরেক আনন্দ, পাড়ার সব কাকু-কাকিমা, ভাই-বোন, বন্ধুরা মিলে বড়ো বাস এ লাফালাফি-ঝাপাঝাপি করে নতুন জামা-প্যান্টের দফারফা করে ফেলা, রাস্তায় বিশাল জোরে জোরে ভেপু বাজানো- সেই তখনি উপলব্ধি করেছিলাম প্রথম, সারারাত জেগে ঠাকুর দেখার কি আনন্দ !! আর একটা ব্যাপার ছিল তখন, যা বহুবছর ধরে মিস করি আমি, সেটা হলো দিদির সাথে পুজোয় বেরোনো | বাবা মা এর অনুশাসনের থেকে আমার জন্য একটুকরো মুক্তি বলতে ছিল আমার দিদি ই.. হেদুয়ার মোর দাঁড়িয়ে আইসক্রিম ই হোক বা রোল-সেন্টারে র রোল ই হোক, ওই সন্ধ্যেটা আমার জন্যে ছিল ইস্পেশাল |
এবার আস্তে আস্তে বড়ো হলাম,১৬ -১৭ টা দুর্গাপুজো কাটিয়ে ফেলার পর, একটু ডানা পালক গজালো, চেন্নাইতে পাকাপাকি ভাবে ৫ বছরের জন্য সেট্লড হলাম |
পুজোর ওই ৪ টি দিনের জন্য বাড়ি যাওয়া শুরু, আস্তে আস্তে অনুমতি পেলাম বন্ধুদের সাথে বেরোনোর | এতোবছরে একটি জিনিস কিন্তু কনস্ট্যান্ট ছিল, ষষ্ঠীর দিন মা এর সাথে গিয়ে লাইন দিয়ে ষষ্ঠী-তলায় ষষ্ঠী পুজো দেওয়া.. সক্কালবেলা ওই পুজো দিতে যাওয়ার সময়ে ঠাকুরের প্রসাদের নাম করে কেনা আহিরীটোলার বিষ্ণু মিষ্টান্ন ভান্ডারের গুজিয়া আর রসগোল্লার পায়েস টা যেন অমৃত !! যাই হোক, এবার আসি বন্ধুদের কথায় ! সারাবছরে ওই যখন অনুব্রত, ফাল্গুনী, ঈশিতা, সোমনাথ, শিউলি, সপ্তর্ষি এদের সঙ্গে প্রথম দেখাটা হয়, জীবনের সকল জতিল-কুটিল গল্পের ভান্ডারটা সাজিয়েই নিয়ে আসি আমরা, যেন গল্পগুলো এই দিনটার ই প্রতীক্ষায় বসে ছিল মুক্তির আশায়, কখন ফেসবুক এর গন্ডিটা পেরোতে পারবে !! প্রথমবার আমি আর অনুব্রত পা এ হেটে পুরো সাউথ- কলকাতা র সব বিখ্যাত ঠাকুরগুলো দেখেছিলাম, যাদবপুর এর দিকের শেষ ঠাকুরটা দেখে চরম ক্লান্ত হয়ে যখন দুজনে মেট্রো স্টেশনে বাড়ি ফেরার জন্য এসে বসেছি, তখন যেন বেশ দিগ্বিজয় করে ফেলেছি, এরম উপলব্ধি হচ্ছিলো আমাদের !! আর সাথে সাথেই পরের দিনের সিনেমা দেখার আর ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানটাও সেরে ফেলা ! আগেরবার এ অনুব্রত আর শিউলি র সাথে বেরিয়ে হঠাৎ করে অয়নদার সাথে পরিচয় হওয়া আর ঘোরাটাও বেশ মনে ধরেছিলো !
ওই B.Sc. 2nd Year এই শেষবারের মত দুর্গাপুজো- এ কোলকাতা আসা। চেন্নাই এ গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার দুর্গাপুজো কাটিয়েছি, মজা-খাওয়াদাওয়া সবই হয়েছে, কিন্তু সেই আবেগটা পাইনি সেখানে।
আগামী কয়েক বছরে এটাই বোধহয় আমার শেষ দুর্গাপুজো। বাইরে প্রবাসী বাঙালীদের পুজোয় আর যাই হোক, এই আবেগ খোঁজার মূর্খতা আমি করবো না- দুধের স্বাদ কি কখনো ঘোলে মেটে? মহালয়ার দিন ভোর চারটের সময় রেডিও টা চালিয়ে মনটা খারাপ হবে জানি, সকালে উঠে whatsapp এ বন্ধুদের শুভ পঞ্চমী মেসেজগুলো দুঃখটা আরও বাড়িয়ে দেবে এও জানি। মা যখন ভিডিও কলে মাথায় ষষ্ঠীতলার ফুল ছোঁয়াবে- অনুব্রত যখন ফোনে এগডালিয়া র প্যান্ডেলটা কিরম সুন্দর হয়েছে তার বর্ণনা দেবে- শিউলি যখন মেসেজ এ বলবে আমার সাথে হাত ধরে ঘোরাটা ও কিরকম মিস করছে- তখন অলক্ষ্যে হাসবে বিধাতা- “You can leave the city of joy, but the city never leaves you!”
দুর্গাপুজো টা আসলে কোনো উৎসব নয়, দুর্গাপুজো মানে আরেকবার মা বাবা কে দেখতে পাওয়া, আরেকবার বাড়ি যাওয়া, আরেকবার বন্ধুগুলো র সাথে মজা-আড্ডা- খুনসুটি !!
দুর্গাপুজোটা একটা emotion !!